মাইথন থেকে একটি
দেখূন ঃ---
মাইথনটা এক বার ঘুরে এলে কেমন হয়, বেশ কিছু দিন ধরেই মাথায় ঘুরছিল কথাটা। এক দাদার কাছে শুনছিলাম মাইথনে থাকার সেরা জায়গা ডিভিসি-র অতিথিশালা মজুমদার নিবাস। ইন্টারনেটে খানিক তল্লাশি চালাতেই খোঁজ মিলল। মনের মতো বুকিং পেতে লেগে গেল প্রায় এক বছর।
বাসে আসানসোল। সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা মজুমদার নিবাস। পৌঁছে বুঝলাম দাদা একটা বাক্যও বাড়িয়ে বলেনি। মাইথন ওয়াটার বডির ভেতরে একটা ছোট্ট দ্বীপ। সেখানেই এই মজুমদার নিবাস। বেশ কিছুটা কংক্রিটের রাস্তা। আর তার পর লোহার তৈরি সেতু পেরিয়ে পৌঁছতে হয় সেখানে। অতিথিশালার ভেতরেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। লনটাও ভারী সুন্দর, বাগানে ঘেরা।
পথের ক্লান্তি কাটাতে দুপুরে মাইথন ড্যাম ঘুরে দেখতে। বহু দূর বিস্তৃত ড্যামটির এ-পারে পশ্চিমবঙ্গ আর ও-পারে গেলেই ঝাড়খণ্ড। বাঁধের কাছে পরপর অনেক ফুড স্টল। ফুচকাওলা দেখেই এগিয়ে গেলাম। একটু যেন অন্য রকম।
আশপাশটা ভাল করে ঘুরে দেখার পালা। কিন্তু কী ভাবে ঘুরব, কী দেখব, তেমন কিছুই জানা ছিল না। মুশকিল আসান হয়ে দেখা দিলেন অটো চালক দীপঙ্করদা। আমাদের ‘গাইড’। মাইথনের গুগল ম্যাপও বলা চলে।
পাঞ্চেত বাঁধ, মোবারকের স্নেক পার্ক থেকে ভাণ্ডার পাহাড়, কল্যাণেশ্বরী মন্দির, থার্ডডাইকের অপরূপ শোভা, জুবিলী পার্ক— ঘুরে দেখলাম খুটিনাটি সব। অনেক নাম না জানা জায়গাও দেখালেন দীপঙ্করদা। প্রকৃতির রূপ সেখানে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।
পরের দিন জলভ্রমণের পালা। মজুমদার নিবাসের অদূরেই বোটিং পয়েন্ট। বিকেলে সেখান থেকে বোট ভাড়া করে চলে গেলাম সবুজদ্বীপ। সত্যিই বড় সবুজ। ওখান থেকেই দেখলাম উল্টো চামচের মতো দেখতে চামচ দ্বীপ, আনন্দ দ্বীপ। স্থানীয়রাই এমন নাম রেখেছে।
তার আগে সকাল সকাল বেড়িয়ে এলাম মাইথন বোটিং ক্লাবে। শুনলাম এক সময় প্রোজেক্ট চলাকালীন অফিসারদের সপ্তাহান্তের বিনোদনের জায়গা ছিল এটি। বোটিং, রোইং কম্পিটিশন হত, থাকত সারা দিনের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা, একেবারে সাহেবি কায়দায়। অতীতের সেই সব জাঁকজমকের কথা ভাবতে ভাবতেই ফেরার রাস্তা ধরলাম। মনে রয়ে গেল তিন দিনের সেই ছোট্ট সফরের সুখস্মৃতি।
বিজয়নগরের রাজধানী দেখতে চলুন ঃ-
আপনাদের যদি জিজ্ঞেস করি ভারতের সবচেয়ে দীর্ঘকালীন ( প্রাদেশিক ) শাসনকারী রাজবংশের নাম কি, জানি অনেকেই মাথা চুলকোবেন। সত্যি বলতে দিনকয়েক আগে আমি নিজেই এর উত্তর জানতাম না। বছরের শেষদিনে রাঁচির কাছাকাছি কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায় খুঁজতে খুঁজতে জানতে পারলাম নবরত্নগড় এবং ছোটনাগপুরের নাগবংশী রাজত্বের কথা। ৬৪ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ( প্রথম শাসক ফণী মুকুট রাই, যিনি স্থানীয় উপকথা অনুযায়ী ছিলেন আদিবাসীদের এক উপাস্য দেবতার পুত্র ) ভারত স্বাধীন হওয়া অবধি এনারা ছিলেন ঝাড়খণ্ড মালভূমির এক বিস্তীর্ণ এলাকার শাসক। দিল্লীর মসনদে সুলতানী, মুঘল বা পরবর্তীকালে ব্রিটিশ শাসনকালে সাময়িক বশ্যতা স্বীকার করলেও স্থানীয়ভাবে এদের প্রতাপ ছিল অটুট। রাঁচির কাছাকাছি পিথরিয়া ( সুতিয়াম্বে ) তে ছিল নাগবংশী দের প্রথম রাজধানী আর নবরত্নগড় তৃতীয়। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের হাতে রাজা দুর্জনশল বন্দী ছিলেন দীর্ঘ বারো বছর। মুক্তি লাভের পর আরো নিরাপদ জায়গায় রাজধানী স্থানান্তরিত করার ভাবনা থেকে বেছে নেন দইসা কে, ১৬৩৬-৩৯ এর মধ্যে গড়ে তোলেন নবরত্নগড়, ভবিষ্যতের প্রায় দুশো বছরের জন্য নাগবংশী দের রাজধানী।
গাড়ি থেকে নেমে এক ঝলক দেখেই যে জায়গাটির কথা আমার প্রথম মাথায় আসলো সেটি হল হাম্পি, বিজয়নগরের রাজধানী। অবশ্যই হাম্পী র মত বিস্তীর্ণ নয়, কিন্তু টপোগ্রাফি অনুসারে একইরকম। অদূরে সংকীর্ণ জলধারা, উঁচু নিচু টিলা আর বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তর, তার মাঝে মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ধ্বংসাবশেষ আর গোল গোল পাথরে সাজানো পাহাড়। আমরা দেখলাম দুটি পাথরের মন্দির, একটি টেরাকোটার ইঁটের মন্দির, একটি বিশাল জলাশয়, আরেকটি বিশাল মন্দির ও সংলগ্ন ম্যানসন ( এক ভদ্রলোক বললেন সেটা নাকি কোর্ট ও প্রিজন সেল / সৈন্য দের আবাস ছিল ), পাহাড়ের মাথায় একটি দোতলা ওয়াচ টাওয়ার ও মূল প্রাসাদ। মূল প্রাসাদটি আপাতত পাঁচতলা হলেও আগে নাকি সাততলা ছিল, ভূমিকম্পে দুটি তলা নাকি বসে গিয়েছে। রয়েছে মূল প্রাসাদে প্রবেশের ফটক এবং পরিখার অবশিষ্ট। পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধীনে আরও খোড়ার কাজ এবং বর্তমান কাঠামো গুলির রিভাম্পের কাজ চলছে। সব মিলিয়ে আমাদের দেখতে সময় লেগেছিল ঘণ্টা দেড়েক এর মত।
রাঁচি থেকে পৌঁছতে সময় লাগবে ঘণ্টা দুয়েক। রাঁচি গুমলা সরকে ৬৫ কিমি দূরত্বে সিসই, সেখান থেকে বাম হাতে আরো কিলোমিটার সাতেকের দূরত্ব। শেষ ৭ কিমি ছাড়া রাস্তা যথেষ্টই ভালো, ভরসা করা যায় গুগল বাবাজীকেও। তবে আশেপাশে কোনো খাওয়ার দোকান নেই আর যেহেতু স্বল্পচেনা তাই নির্জন। সুতরাং চেষ্টা করবেন দিনমানে দেখে ফিরে আসার।
জল বাঁচান, গাছ লাগান। বেড়াতে গিয়ে প্লাস্টিকের প্যাকেট বা বোতল ফেলে আসবেন না। নবরত্নগড়ের আরো ছবি বা বেড়াতে যাওয়ার আরো পোস্টের জন্য আমাদের একই নামের ইনস্টাগ্রাম পেজ দেখতে পারেন।
0 মন্তব্যসমূহ